Essay 4. ‘What Babasaheb Ambedkar Means to Me’
মহীতোষ মণ্ডল (Mahitosh Mandal)
অসুস্থতার কারনে ২০১৫ সালে রুবি হসপিটালে ভর্তি হই । জীবনের প্রথম অপারেশন ।জীবনে প্রথম হসপিটালে রাত কাটানো । স্বাভাবিকভাবেই তীব্র একাকীত্ব ও ভীতি ঘিরে ধরেছিল । সঙ্গে ছিল একটা ট্যাব আর তাতে আম্বেকরের কয়েকটা টেক্সটের পিডিএফ । ট্যাব ঘাঁটতে ঘাঁটতে খুলে ফেলি ‘কাস্টস ইন ইন্ডিয়াঃ দেয়ার মেকানিজম, জেনেসিস, অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ । ১৯১৬ সালে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ববিদ্যার কনফারেন্সে আম্বেদকরের প্রেজেন্ট করা রিসার্চ পেপার । পড়তে পড়তে হসপিটালের বিছানায় উঠে বসি । আর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে যাকে বলে প্রায় এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলি এই ছোট্ট অথচ জ্ঞানগর্ভ একটা টেক্সট । নৃতত্ত্ববিদ্যা নিয়ে আমার বরাবরের ফ্যাসিনেশন । ইউরোপীয় নামীদামী নৃতত্ত্ববিদদের লেখা একসময় গোগ্রাসে গিলেছি। এদের মধ্যে আমার প্রিয় ছিল ক্লদ লেভি-স্ত্রস এবং মার্সেল মস । কিন্তু আম্বেদকরের এই ছোট্ট লেখাটি পড়ার পর বুঝলাম এবার নৃতত্ত্ববিদ্যার প্রিয় টেক্সটগুলির মাঝে অন্যতম জায়গাটা আম্বেদকরের জন্যই ছেড়ে দিতে হবে । শুধু এই একটিমাত্র টেক্সট নয়, আম্বেদকরের যেকোন টেক্সটের পাতায় পাতায় ভরে আছে প্রজ্ঞা, ভরে আছে আগুন ।
এখন প্রশ্নটা হল আমি ছাত্রাবস্থায় বহুদিন পর্যন্ত আম্বেদকর পড়িনি – কেন? উত্তরটা সোজা – আম্বেদকর পড়ার কথা কেউ বলেনি । আম্বেদকর পড়তে কেউ উৎসাহিত করেনি । আম্বেদকর নিয়ে এন্টায়ার একটা কোর্স অফার করা হয় নি – যেটার খুব দরকার ছিলো ও যেটার খুব দরকার আছে। পশ্চিমবঙ্গের তথাকথিত নামীদামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমি পড়েছি । যেখানেই পড়েছি সাফল্যের সঙ্গে প্রথম সারিতেই উত্তীর্ণ হয়েছি । পড়াশুনো করা কালীন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সব চিন্তাবিদদের লেখা পড়েছি ও অভিভূত হয়েছি । কিন্তু তাদের প্রায় সবাই ইউরোপীয়। আমাদেরকে ভাবতে বাধ্য করা হয়েছে যে ভারতে কোন প্লেটো বা মার্ক্স বা ফ্রয়েড বা দেরিদা নেই । কিছুটা হলেও এরকম দাবী হয়তো সত্যি । কিন্তু যখন আম্বেদকর পড়া শুরু করলাম তখন বুঝলাম মানুষটি জাতপাতের দিক থেকে হয়তো তথাকথিত ‘নিচু’জাতের – তবে চিন্তাবিদ হিসেবে যাকে বলে পুরো একটা অন্য ‘ক্লাস’ ।
আম্বেদকর চর্চার দিক থেকে শিক্ষিত ও আত্মতুষ্ট বাঙ্গালীরা করুনভাবে পিছিয়ে । পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ইংরেজীবিভাগগুলিতে (ও কলাবিভাগগুলিতে), যেখানে আজকাল বিশ্বের তাবড় তাবড় চিন্তাবিদদের লেখা পড়ানো হয়, সেখানে দিনের পর দিন এই যে আম্বেদকরকে বাদ দেওয়া বা গুরুত্ব না দেওয়া – তার পিছনে আছে এক সুপরিকল্পিত রাজনীতি । ‘রাজনীতি’ শব্দটা ব্যাবহার করলাম ইচ্ছে করেই – এতে ভ্রু কুঁচকানোর কিছু নেই । যারা ‘পলিটিক্স অব ক্যানন’ নামক তত্ত্ব নিয়ে অগ্নিগর্ভ বক্তৃতা দিয়ে এপিআই স্কোর বাড়ায় তাদের অন্তত এই শব্দটিতে আপত্তি থাকার কথা নয় । যাইহোক, আম্বেদকরকে বাদ দেওয়া বা অবহেলা করার পিছনে আছে আরো জটিল ও সাঙ্ঘাতিক ধরনের রাজনীতি ।
আম্বেদকর একবার বলেছিলেন ‘আই অ্যাম দ্য মোস্ট হেটেড ইন্ডিয়ান’ । আম্বেদকরকে যারা ঘৃণা করত তারাই দশকের পর দশক চেষ্টা করে গেছে যাতে আম্বেদকর সিলেবাসে জায়গা না পান । ছোটবেলায় স্কুলে আম্বেদকরের জীবনের অস্পৃশ্যতার কাহিনী দু-একটা ছোট প্যারাগ্রাফে রেখেই কাজ সেরেছেন বাঙালি সিলেবাস-নির্মাতারা । মনে আছে একটা ছোট গল্প ছিল যেটাতে কিভাবে তিনি অস্পৃশ্যতার শিকার হয়েছিলেন সেটার উল্লেখ ছিলো । অর্থাৎ একজন দলিতের জীবনকাহিনী বেশী আকর্ষণীয় – তাঁর ক্রিটিকাল চিন্তা বা লেখা নয় । এই যে আম্বেদকর হিন্দুধর্মের তীব্র সমালোচক ছিলেন যে জন্য ‘মহাত্মা’ গান্ধী তাকে ‘চ্যালেঞ্জ টু হিন্দুইজম’ আখ্যা দিয়েছিলেন, এই যে তিনি রীতিমত গবেষণা করে ও জীবন দিয়ে বুঝেছিলেন হিন্দুধর্ম ‘লিবার্টি-ইকুয়ালিটি-ফ্রেটারনিটি’র ঘোর বিরোধী – এইসব ও আরো নানা র্যাডিকাল লেখা বরাবরই, যাকে বলে, ‘সাপ্রেস’ করে রাখা হয়েছে । আম্বেদকরই পেরেছিলেন হাজার হাজার বছরের হিন্দু ‘সভ্যতা’কে কিছু কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাতে । কি করেছে এই হিন্দুধর্ম ‘নিচু’ জাতের মানুষদের জন্য? কি করেছে এই ধর্ম নারীদের জন্য? কি করেছে হাজার হাজার বছরের এই সভ্যতা আদিবাসীদের জন্য? ব্রাহ্মন্যবাদে পূর্ণ একটা দেশ খন্ড খন্ড হয়ে গেছে ধর্মের নামে, জাতের নামে । আর সেকারনেই বিদেশী আক্রমনে বারবার ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে এই দেশ । এরকম অজস্র ‘আনকমফরটেবল’ প্রশ্ন তোলে যার লেখা বার বার তার লেখা এই ব্রাহ্মন্যবাদ অধ্যুষিত সমাজে যে ঘৃণিত হবে সেটাই তো স্বাভাবিক । যদি সুন্দর, উন্নত দেশ গড়ার স্বপ্ন ও সৎ সাহস থাকে তাহলে আমাদের অচিরেই উচিত এই ঘৃণার রাজনীতির ও ঘৃণার ইতিহাসের উপযুক্ত পর্যালোচনা করা – যা এখনো সঠিকভাবে করা হয় নি । যারা ‘লিটারেচার অ্যান্ড সেন্সরশিপ’ নামক কোর্স নিয়ে এতো আগ্রহ প্রকাশ করেন তাদের কোন ধারনাই নেই যে আম্বেদকরের লেখার যে সাপ্রেশন, নন-পাবলিকেশন আর সেন্সরশিপের ইতিহাস সেটা বাঙালী তথা ভারতীয় ছাত্রদের জানাটা কত জরুরী ।
আমরা অনেকেই জানি ঘৃণার সঙ্গে উদ্বেগের একটা সম্পর্ক আছে । আম্বেদকর হিন্দুধর্ম, হিন্দু সভ্যতা, ও হিন্দুদের ইতিহাসের বিরুদ্ধে কোন ভিত্তিহীন চীৎকার করে যাননি । আইন নিয়ে পড়াশুনো করেছিলেন তো ! অপ্রাসঙ্গিক বা প্রমাণহীন কোন কথা তিনি বলতেন না । তাই যেসব যুক্তিযুক্ত অভিযোগ তিনি করেছিলেন ভারতের ‘অফিসিয়াল ব্রাহ্মিনিকাল হিস্ট্রি’র বিরুদ্ধে এবং সেই নিরিখেই ভারতের যে ‘অলটারনেটিভ হিস্ট্রি’ তিনি লিখে গেছেন সেটা যদি তরুণ ছাত্রছাত্রীদের হাতে এসে পড়ে তাহলেই বিপদ । ব্রিটিশরা যখন হিন্দুধর্ম ও ভারতীয় সভ্যতার নিন্দে করত তখন সহজেই বলা যেত যে ফরেনার তথা কলোনাইজাররা ভারতের নিন্দে করবে সেটাই স্বাভাবিক । কিন্তু আম্বেদকরের সমালোচনা সেরকম কোন অজুহাতে ফেলে দেওয়ার জো নেই । ভারতের মাটি থেকেই উঠে আসা, সমাজের সব থেকে নিচু তলার থেকে উঠে আসা, তথা তুখোড় এক চিন্তাবিদের কলম থেকে বেরোন হিন্দু-বিরোধী সমালোচনা হজম করা উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মন্যবাদীদের পক্ষে খুব শক্ত। তাই ছাত্রছাত্রীরা যদি সিরিয়াসলি আম্বেদকরের সেইসব র্যাডিকাল চিন্তা পড়া শুরু করে তাহলে ব্রাহ্মন্যবাদের যে ভারতব্যাপী সাম্রাজ্য – অ্যাকাডেমিক্স, পলিটিক্স, মিডিয়া, লিটারেচার, সিনেমা ও অন্যান্য সব ক্ষেত্রে – তা ভেঙে পড়বে অচিরেই । আম্বেদকর গভীরভাবে পড়া শুরু করলে হিন্দুরাজ্য তৈরির স্বপ্ন হবে ধূলিসাৎ । সে বড় সুখের সময় হবে না । তাই উদ্বেগ । তাই আম্বেদকরকে বাদ দেওয়ার রাজনীতি ।
এসব হিন্দুত্ববাদী ও ব্রাহ্মন্যবাদীদেরকে আম্বেদকর, যাকে বলে, হাড়েহাড়ে চিনতেন । তাই শেষদিকে নিজের লেখার একাধিক কপি টাইপ করিয়ে রাখতেন – যাতে গোঁড়া কেউ একটা-লেখা নষ্ট করে দিলে অন্য কপিগুলো থেকে যায় । আবার তিনি জানতেন শুধু লিখে বা বক্তৃতা দিয়েও সব উদ্দ্যেশ্য সাধন হবে না । সমাজ পরিবর্তন করতে গেলে প্রয়োজন আরো কংক্রিট কিছু পদক্ষেপ – চিন্তাকে ফলপ্রসূ করার জন্যে প্রয়োজন যাকে বলা যায় ‘ফিলসফি অব প্রাক্সিস’ । আর সেরকম অনেক পদক্ষেপের একটা তিনি নিয়েছিলেন ভারতের সংবিধান রচনা করার মাধ্যমে । এই সংবিধানেই তিনি ‘রেপ্রেজেন্টেশনে’র ধারনাটা আইনসম্মত করে দেন । তার জন্য তাকে অনেক তর্ক অনেক যুক্তির লড়াইয়ে জিততে হয়েছিলো । তিনি পরিষ্কার বলে দেন যে হাজার হাজার বছর ধরে ভারতের ব্রাহ্মণ তথা উচ্চবর্ণের মানুষেরা যাদেরকে সবক্ষেত্রে বঞ্চিত ও পদদলিত করে রেখেছে এবার তাদেরকে মানুষের সম্মান ও সুষ্ঠুভাবে বাঁচার অধিকার দিতে হবে । দলিত-আদিবাসী-বহুজন সমাজের যে বঞ্চনার কথা তিনি বলেছিলেন সেটা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বঞ্চনা নয় – তা সামাজিক ও সাংস্কৃতিকও বটে । তাই তথাকথিত ‘রেজারভেশন’ শুধুমাত্র ‘ফিনান্সিয়াল ক্যাপিটাল’ না থাকা মানুষদের জন্য নয় – তা ‘কালচারাল ক্যাপিটাল’ না থাকা ‘সোশালি ব্যাকওয়ার্ড’ কাস্টদের জন্য । কিন্তু ব্রাহ্মন্যবাদীদের ঘৃণা ও উদ্বেগের কারনে রেজারভেশনের এই ‘পজিটিভ’ দিকটা চাপা পড়ে গেছে ।
ভারতবর্ষের আজকের দিনের ‘কাস্ট সিচুয়েশন’ আর একশ বছর আগের ‘কাস্ট সিস্টেমে’র মধ্যে ফারাক আছে বইকি । আজ সারা দেশব্যাপী সুপরিকল্পিত যে অ্যান্টি-রেজারভেশন প্রপাগান্ডা সেটাকে কাস্টিজম ছাড়া অন্যকিছু বলা যায় না । আজও যে দলিত-আদিবাসী-বহুজন সমাজের মানুষকে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হয় সেটা কাস্টিজম । আজ যে পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষিত মহলে কাস্ট নিয়ে কথা বললে মুখ টিপে হাসা হয় অথবা ‘কাস্ট’ শব্দটিকে ‘ক্লাস’ শব্দ দিয়ে চেপে দেওয়া হয় সেটা কাস্টিজম । আজ যে পশ্চিমবঙ্গের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে দলিত-আদিবাসী-বহুজন ছাত্র ও শিক্ষককে অবহেলিত ও অপমানিত হতে হয় সেটা কাস্টিজম । পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু তথাকথিত নাস্তিক ছাত্রছাত্রীরা যখন হিরো-ওরশিপ করে আর এই হিরোরা সব ব্রাহ্মণ হয় তখন সেটাকে কাস্টিজম ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না । দয়া করে মেরিটের গল্প করতে আসবেন না এখানে । ব্রাহ্মণদের এতো মেরিট থাকা সত্ত্বেও একটা প্লেটো বা মার্ক্স বা ফ্রয়েড বা দেরিদা হাজার হাজার বছর ধরেও তৈরি হয়নি এই পোড়া দেশে – দেশটা তৃতীয় বিশ্বই থেকে গেছে। অথচ অস্পৃশ্যদের থেকে উঠে আসা কোন এক আম্বেদকর অরিজিনাল চিন্তা দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন ।
এই যে আমি বললাম আম্বেদকর ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন এই ব্যাপারটা কিন্তু আজকের ব্রাহ্মণ-সবর্ণ অধ্যুষিত বাঙ্গালী শিক্ষিত সমাজ প্রায় জানেইনা । আর এই অজ্ঞতা থেকে শিক্ষিত সমাজে জন্ম নিয়েছে ‘প্রেজুডিস’। যে শিক্ষক ক্লাসে ‘আদার’ বা ‘মারজিনালিটি’ বা ‘রোল অব দ্যা ইন্টেলেকচুয়াল’ বা ‘জেন্ডার-রেস-ক্লাস’ নিয়ে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে ‘হিরো ওরশিপ’ পান – তিনিই রেজারভেশনের গালমন্দ করেন আর রিজার্ভড ক্যাটেগরি ছেলে-মেয়ে-শিক্ষকদেরকে নিচু চোখে দেখেন । অথচ এই হিরো-ওরশিপ পাওয়া শিক্ষকদের উপরেই ভার রয়েছে ছাত্র-গড়ার – আর যে ছাত্র বেশি পিছিয়ে তাকে বেশি কেয়ার নেওয়ার । মেরিটের প্রশ্ন তুলে এরা নিজেদের বৃহত্তর সামাজিক দায়িত্ব এড়িয়ে যান । ক্লাসের তথাকথিত ‘মেধাবী’ ছেলেমেয়েদের নিয়ে এদের কারবার – তেলা মাথায় তেল দিতে এরা ওস্তাদ । অথচ পৃথিবীর ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে যে মেধা কখনই টুপ করে গাছ থেকে পড়েনি । কালচারাল ক্যাপিটল যাদের নেই তাদের কাছে সেই ক্যাপিটল পৌঁছে দিলেই তাদের মধ্যে থেকে ‘মেধা’ বেরিয়ে আসতে পারে। কিন্তু ব্রাহ্মণদের বরাবরের অভ্যাস কালচারাল ক্যাপিটল নিজেদের কুক্ষিগত করে রাখা । ব্রাহ্মণ্যবাদের সেই ট্র্যাডিশন এখনো চলছে । এই ট্র্যাডিশন থেকে মডার্নিটিতে পোঁছানোর জন্য দরকার ব্রাহ্মন্যবাদ আর হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর । সেই লড়াইয়ের গ্রেনেড হতে পারে আম্বেদকরের লেখা । কারন একমাত্র আম্বেদকরই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিনির্মাণ করেছেন ভারতের ইতিহাস । হিন্দুদের ইতিহাস ঘেঁটে ঘেঁটে তিনি দেখিয়েছেন ব্রাহ্মণদের চালাকির নানারূপ । তিনিই রচনা করে গেছেন ভারতের ‘অল্টারনেটিভ হিস্ত্রি’।
তবে যতই বলিনা কেন ‘রিটার্ন টু আম্বেদকর’ প্রয়োজন, উচ্চবর্ণের উন্নাসিক শিক্ষিতেরা যে আম্বেদকরকে ছুঁয়েও দেখবে না সে আমি ভালোমত বুঝি । যতই এরা নিজেদেরকে প্রগ্রেসিভ বলে দাবী করুক না কেনো এরা আসলে মধ্যযুগীয় । আর আম্বেদকরকে ছুঁয়ে দেখলে এদের জাত যাওয়ার তীব্র আশঙ্কা । আসলে আম্বেদকর নিজেও এটা বেশ বুঝতেন । তাই তিনি একবার বলেছিলেন উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মন্যবাদীদেরকে বোঝানো তাঁর কাজ নয় । তাঁর কাজ হল ‘অল্টারনেটিভ হিস্ট্রি’র সাহায্যে দলিত মানুষদের আত্মসচেতন ও অধিকার সচেতন করে তোলা, তাদেরকে সঙ্ঘবদ্ধ করা ও তাদেরকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া । আর ঠিক সেই কারনেই দলিত-আদিবাসী-বহুজন সমাজের কাছে আম্বেদকরকে পৌঁছে দেওয়ার খুব প্রয়োজন । আম্বেদকর তাদের ‘সেলফ-এসারশন’এর সহায়ক হয়ে উঠতে পারেন । ‘এডুকেট-এজিটেট-অরগানাইজ’ তত্ত্ব তাহলেই বাস্তব রূপ পাবে । ভারতের পিছিয়ে পড়া মানুষেরা সমাজে এগিয়ে আসবে । দেশের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি হবে ।
আসলে আম্বেদকরকে পড়ার বা পড়ানোর অন্যতম একটা শর্ত হল এই দেশটার ও এই পৃথিবীর সর্বাঙ্গীণ উন্নতি নিয়ে চিন্তা করার সৎ সাহস । আম্বেদকর সর্বোপরি একজন চিন্তাবিদ ছিলেন । আর দেশের ও পৃথিবীর সর্বাঙ্গীণ উন্নতি নিয়ে চিন্তা করার সৎ সাহস তিনি দেখিয়েছিলেন । চাইলেই তিনি আমেরিকায় থেকে যেতে পারতেন – যা কোয়ালিফিকেশন তাঁর ছিলো; চাইলেই পারতেন নিজের আখেরটা গুছিয়ে নিতে। কিন্তু তিনি দেশের মানুষের জন্য কাজ করতে চেয়েছিলেন । আর শুধু দলিতদের নিয়ে তিনি লিখে যাননি । তিনি ভারতের নারীদের নিয়ে, অ-হিন্দুদের নিয়ে, আদিবাসী-বহুজনদের নিয়ে লিখে গেছেন । তিনি কাস্ট-হিন্দুদের চালাকি, স্বার্থপরতা আর অমানবিকতার গণ্ডী অতিক্রম করতে বলে গেছেন । এই দেশের সমস্ত মানুষকে তিনি একসুত্রে বাঁধতে চেয়েছিলেন – দূর করতে চেয়েছিলেন সমাজ ও রাজনীতির সব ক্ষেত্রের ভেদাভেদ ডিস্ক্রিমিনেশন আর অপ্রেশন। তিনি বিশ্বাস করতেন ভারতবর্ষ এখনো কোন ‘নেশন’ হয়ে ওঠেনি ।ভারতবর্ষ সত্যিকারের ‘নেশন’ হয়ে উঠতে পারে কিনা সে জন্য তিনি ভারতের তো বটেই বিশ্বের ইতিহাসেরও সুতীক্ষ্ণ পর্যালোচনা করে গেছেন । এক্ষেত্রে ভারতে কার্ল মার্ক্স-এর প্রয়োগের অসুবিধা নিয়ে তাঁর চিন্তা বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে । আর তাঁর এসব জ্ঞানগর্ভ লেখায় মিলেমিশে গেছে আইন, অর্থনীতি, ধর্ম, দর্শন, নৃতত্ত্ববিদ্যা, ইতিহাস, সাহিত্য, বিজ্ঞান, এবং আর অন্যান্য বিষয় । ভারতবর্ষ যদি কোন একজন চিন্তাবিদকে নিয়ে অহঙ্কার করার দাবীদার হতে চায় তবে তিনি নিসন্দেহে বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকর ।
[১৭ এপ্রিল ২০১৬ তে দত্তপুকুর আম্বেদকর ওয়েলফেয়ার সোসাইটি (পশ্চিমবঙ্গ)আম্বেদকরকে নিয়ে একটি অনুষ্ঠান করে । উপরের লেখাটি সেই অনুষ্ঠানে রাখা বক্তব্যের খসড়া । ]
~~~~
Image courtesy: Ambedkar.org